কুষ্টিয়া সাংবাদিক ফোরাম ঢাকা – Kushtia Journalist Forum Dhaka

blank

স্যালুট টু এডওয়ার্ড কেনেডি – বিলু কবীর

মার্কিন সিনেটর, যাকে উন্নত বিশ্বের গণতন্ত্রী নেতারা ‘সিনেটরদের সিনেটর’ বলে থাকেন। তিনি এডওয়ার্ড কেনেডি। গত ২৫ আগস্ট তিনি পরলোকগমন করেছেন (তার আত্মার শান্তি হোক)। তাঁর রাজনৈতিক জীবন যেভাবে তাঁকে খ্যাতি দিয়েছে, মার্কিন সিনেটর হিসেবে মানবিক প্রশ্নে তিনি নিজ দেশের সরকারের পর্যন্ত বিরোধিতা করেছেন। আর্তের অনুকূলে আইন ও সিদ্ধান্ত নির্মাণে তিনি রাজনৈতিক গণমুখিতা প্রদর্শন করেছেন সারাজীবন, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁর সমগ্র পরিবারের অবদান, অবস্থান, ঐতিহ্য এবং জনপ্রিয়তা কিংবদন্তিতুল্য। তার দৃঢ় মানসিকতা, তার সাহসী রাজনৈতিক ঔচিত্যবোধের যে অভিব্যক্তি, তা সত্যিকার অর্থেই তাঁকে বিশ্বনন্দিত করে তুলেছে। সেই মহান মানুষটা যখন পরলোকগমন করেন তখন স্বাভাবিকভাবেই পৃথিবী ব্যথিত হবে, মিডিয়া ভালো কাভারেজ দেবে, এটাই স্বাভাবিক।


১৯৭১ সালে আমেরিকা যখন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল তখন টেড কেনেডি নামে সমধিক পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রেরই সিনেট সদস্য এডওয়ার্ড কেনেডি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। সিনেট সভায় ভাষণ দিয়েছিলেন। যুদ্ধকালীন তিনি ভারত সফর করে শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করেছিলেন এবং শরণার্থীদের অবর্ণনীয় কষ্ট এবং দেশের জন্য প্রচণ্ড কষ্টকল্পিত বাস্তবতার সঙ্গে লড়াই করতে দেখে যুগপৎভাবে বিস্মিত এবং ব্যথিত হয়েছিলেন। তিনি এ বিষয়ে একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন সিনেট সভায় উপস্থাপন করে আমেরিকান সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়াটা দুষ্কর্ম করার শামিল। পাকিস্তানকে সমর্থন করাটা বর্বরতাকে সহায়তা করার সমান্তরাল। তিনি ওই সময় আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে বিবৃতি দিয়েছিলেন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল।


আর তাকে নিয়ে লিখতে বসায় যে আন্তরিক তাড়না সেটা হচ্ছে ১৯৭২ সালে তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে এসেছিলেন। মনে পড়ে, মাত্র দুই দিনের সফরে এসে কুষ্টিয়ায় গিয়েছিলেন। আমি তাঁকে দেখেছিলাম খুব কাছ থেকে কুষ্টিয়ায় আমার বাড়ি হওয়ার সুবাদে। আমি জিলা স্কুলের ছাত্র। সেই দিনটির স্মৃতি যে আজ এভাবে লেখার বিষয় হয়ে উঠবে তা কখনো ভাবনায় ছিল না। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ, এদেশের মানুষের অবর্ণনীয় ক্ষতি এবং লড়াকু রক্তাক্ত হৃদয়কে অনুধাবন করে তিনি যে ব্যথিত হয়েছিলেন, তারই প্রকাশ ঘটাতে তিনি এদেশের দুঃখী এবং বীর মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তারই সূচক হলো তিনি ব্যাপক ভ্রমণ ও বৈঠকসূচি নিয়ে মাত্র ২ দিনের সফরে এসেছিলেন বাংলাদেশে। ওই দুই দিন ছিল ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৪ এবং ১৫ তারিখ। সেই দু’দিনে তিনি যা যা করেছিলেন তা হলো-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গমন এবং ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে মতবিনিময়, কলেরা রিসার্চ ল্যাবরেটরি (এখন যেটা আইসিডিডিআরবি) পরিদর্শন, ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের দেখতে যাওয়া, সাভারে গণকবর দেখতে যাওয়া, নারায়ণগঞ্জে খাদ্যগুদাম ও বন্দরব্যবস্থা সরেজমিনে পরিদর্শন করা, সংবর্ধনায় উপস্থিত থাকা, ১৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা, ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা, নৈশভোজে অংশগ্রহণ করা, মিসেস কেনেডির বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে (৩২ নম্বর বাসভবন) যাওয়া। মাত্র দুই দিনের এত দীর্ঘ প্রোগ্রামের মধ্যে আরও একটি কাজ এডওয়ার্ড কেনেডি করেছিলেন, সেটা হলো কুষ্টিয়ায় যাওয়া। তিনি জেনেছিলেন, বাংলাদেশের যেসব জেলাশহর মুক্তিযুদ্ধে খুব বেশি রকম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কুষ্টিয়া তার মধ্যে একটি। যে শহরটি পুরোটাই পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল 138 এবং যার চিত্রপটকে ২য় বিশ্বযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত কোনো শহরের সঙ্গে তুলনা করে আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে খবর ছাপা হয়েছিল। এমতাবস্থায় এডওয়ার্ড কেনেডি বিধ্বস্ত কুষ্টিয়াকে এবং সেখানকার শরণার্থীদের ফিরে আসা-উত্তর দুরবস্থা দেখতে এসেছিলেন। আমার মনে আছে, আমরা স্কুল থেকে ওই দিন (ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখ হবে) পুলিশলাইন মাঠে গেলাম। অন্যান্য স্কুলের ছেলেমেয়েরা ও অন্যান্য সেক্টরের লোকেরাও সেখানে সমবেত হয়েছিলেন। আমার খুব মনে আছে, সেই মাঠে শিল্পী আব্দুল জব্বার উপস্থিত ছিলেন, উপস্থিত ছিলেন উঠতি শিল্পী কম বয়েসী ফরিদা পারভীনও। সকালের দিকে একটি হেলিকপ্টার এসে নামল পুলিশলাইনের মাঠে । আমরা হাত নাড়লাম, জ্বলেপুড়ে ছারখার কুষ্টিয়া জেলার পক্ষ হতে এই ছিল মামুলি অভিবাদন। হেলিকপ্টার থেকে নামলেন এডওয়ার্ড কেনেডি এবং তার স্ত্রী জোন কেনেডি। সঙ্গে আরও এক যুবক ছিলেন। শুনেছিলাম তিনি নাকি এডওয়ার্ড কেনেডির ভ্রাতুষ্পুত্র। আন্দাজ করি ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামও ওই হেলিকপ্টারেই গিয়েছিলেন কুষ্টিয়ায় । তখন তিনি আরও বেশি সুদর্শন। আমাদের কনস্টিটিউয়েন্সির পর্লামেন্ট মেম্বর এবং স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার খাদ্য প্রতিমন্ত্রী। আরও বেশ কয়েকজন ইংরেজকে সেদিন কুষ্টিয়ায় দেখেছিলাম। মানুষ যাকে দেখে তাকে নিয়েই কানাঘুষা করে বলে : এই হলেন মার্ক টালি । এই হলেন উইলিয়াম ক্ৰলি । তখন কুষ্টিয়ার মানুষ দুজন ইংরেজকে নামে চিনতো, তাদের অসম্ভব জনপ্রিয়তা ছিল প্রফেশনের কারণে। তারা হলেন ওই সময়ে বিবিসির দক্ষিনএশিয়া প্রতিনিধি মার্কটালি এবং উইলিয়াম ক্রলি। তাদের প্রতি ভীষণ দুর্বলতা ছিল বলেই তাদের একনজর দেখলে মনটায় শান্তি হয়। বিবেচনাতেই ওইদিন আমরা যাকেই ইংরেজ দেখেছি, তাকেই ভেবেছি এই বুঝি আমাদের মার্কটালি, এই বুঝি আমাদের উইলিয়াম ক্রলি। কেনেডি কুষ্টিয়া ইউনাইটেড হাইস্কুলের মাঠে ভাষণ দিয়েছিলেন এই ঘটনার আগে বা পরে। (কয়েকদিন পরই হবে)। ওই একই মাঠে ভাষণ দিয়েছিলেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মেম্বার জন স্টোনহাউজ। সেই সময়ও ওই মাঠে ছিলাম আমরা। জন স্টোনহাউজ তার পুরো ইংরেজি ভাষণের মধ্যে একটি বাংলা বাক্য বলেছিলেন। নিশ্চয়ই খুব কষ্ট করে এই বাংলা বাক্যটি তিনি রপ্ত করে এসেছিলেন। বাংলাদেশে পাকসেনাদের বর্বরতার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেছিলেন, আমি খুব ডুখা পাইসি (আমি খুব দুঃখ পেয়েছি)। তার এই ইংরেজি ধাঁচের বিকৃত বাংলায় আমরা মজা পেয়ে খুব একচোট হেসেছিলাম। কিন্তু বিষয়টি হাসির ছিল না। দুঃখের ছিল, আমাদেরই দুঃখে তার দুঃখে প্রকাশ ছিল। যাই হোক, কেনেডি, সেই অকৃত্রিম বন্ধুটি আজ মারা গেছেন, আমরা তাঁকে হারালাম, আমেরিকা হারালো, পৃথিবী হারালো। এ বড়ো বেশি রকম হারানো। তার চিরশান্তি হোক। আত্মার মুক্তি হোক। পঞ্চাশ বছর ধরে রাজনীতিতে অবদান রাখা এই সিনেটর কেবল সিনেটরদের সিনেটর ছিলেন না, তিনি ছিলেন ব্রাত্যজনেরও সিনেটর, সংগ্রামী বঞ্চিত মানুষেরও প্রতিনিধি। তার অন্য দুই ভাই প্রেসিডেন্ট জন কেনেডি এবং সিনেটর রবার্ট কেনেডি। এক ভাই প্রেসিডেন্ট জন কেনেডি আততায়ীর হাতে নিহত হন। সে হচ্ছে ১৯৬৩ সালের কথা। অন্য ভাই রবার্ট কেনেডি নিহত হন ১৯৬৮ সালে। তাদের অপর ভাই ছিলেন বৈমানিক, তিনিও মারা গিয়েছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় । এই ভাইয়ের নাম ছিল জো কেনেডি। অর্থাৎ কেনেডিরা যে চার ভাই ছিলেন, তাদের মধ্যে এক ভাই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, দুই ভাই সিনেটর, এক ভাই বৈমানিক। এই চার ভাইয়ের মধ্যে একমাত্র এডওয়ার্ড কেনেডি ছাড়া অন্য কারোরই স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। প্রেসিডেন্ট ভাই এবং পরের সিনেটর ভাই দু’জনই নিহত হওয়ার পর (বৈমানিক ভাই তো ১৯৪৪ সালে মারা গেছেন, আগেই) তিনি রাজনীতিতে আবির্ভূত হন। তারা ছিলেন নয় ভাইবোন। ভাই জন কেনেডি যখন ১৯৬২ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হন, তখন তিনি ম্যাসাচুসেটসের সিনেটরের পদটি ছেড়ে দেন। সেই পদে এডওয়ার্ড কেনেডি নির্বাচিত হয়ে ৩০ বছর বয়সে আমেরিকার ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ সিনেটর হওয়ারও সম্মান অর্জন করেন। এরপর তিনি মোট সাতবার সিনেটর হিসেবে নির্বাচিত হন। অর্ধশতাব্দীর রাজনীতিক হিসেবে তাঁর যে জনপ্রিয়তা, তা ব্যাপক হলেও প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল না, বলে তার পার্টি মনে করেছিল। কারণ, ১৯৮০ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়ন লাভে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তবে তাতেও ক্ষতির চেয়ে লাভের পরিমাণ নিতান্ত কম নয়। এই সময় তিনি Dream will never ফরব শীর্ষক একটি ভাষণ দিয়ে বিখ্যাত হয়েছিলেন আরও। তিনি পঞ্চাশ বছর সিনেটরের দায়িত্ব পালন করেন। এই দীর্ঘপর্বের সময়টি নানা কাজে বর্ণাঢ্য ছিল, গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অভিবাসন, ন্যূনতম মজুরি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নাগরিক অধিকার এসব বিষয়ে তিনি সিনেটর জীবনে অবদান রেখেছেন এবং রাখার চেষ্টা করেছেন। উত্তর আয়ারল্যান্ডের শান্তি প্রক্রিয়ায়ও তার অবদান অবিস্মরণীয় কাজ। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ইতিহাসে ইমিগ্রান্টদের অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে তিনি সর্বদা সোচ্চার ছিলেন। ১২ মিলিয়ন অবৈধ অভিবাসীকে বৈধতা দেয়ার বিল এনেছিলেন তিনি। যদিও সেটা পাস হয়নি। তার জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা কতটা ছিল তা বোঝা যায় ২০০৬ সালে টাইম ম্যাগাজিনের জরিপে। তাতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ১০ সেরা সিনেটরের মধ্যে একজন নির্বাচিত হন। এছাড়া তার গ্রহণযোগ্যতা এবং জনপ্রিয়তার সূচক হিসেবে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন বলে মনে করি।রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমেরিকায় এবং সারা পৃথিবীতে তার যে অবস্থান, তার যে মানবিক বিচক্ষনতা, তার যে সুস্পষ্ট রাজনৈতিক মূল্যবোধ, যে বাকনিৰ্ভীকতা, তাতে করে আমি দৃঢ়বিশ্বাসী যে, আমেরিকার রাজনীতিতে তার পরিবারের যে ভূমিকা, ক্ষতিস্বীকার, ঐতিহ্য এগুলো না থাকলেও তিনি এমনই জনপ্রিয় হতেন। অতীত পটভূমি বা পারিবারিক ভাবমূর্তি তাকে এই পর্যায়ে উন্নীত হতে সহায়তা করেছে অবশ্যই। কিন্তু সেটাই তার মূল বা একমাত্র ভিত্তি নয়।

Write a comment